শুরুতেই প্রচ- হোচট খেয়েছিলেন। তপ্ত রোদে রাজধানী ঢাকার পিচঢালা পথে হেটে-হেটে শরীরের ঘাম ঝড়িয়েছেন দিনের পর দিন। তবুও ক্লান্ত হয়ে ভেঙে পড়েননি তিনি। ধানমন্ডি থেকে বাংলামোটর, যাত্রাবাড়ি থেকে উত্তরা কিংবা পুরান ঢাকার অলিগলি- এখনও তাঁর নখদর্পণে। সাথে ছিলেন বন্ধু সুদীপ্ত পাল। সময়টা ২০০৪।বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই সারাক্ষণ মাথায় ঘুরতো বিভিন্ন ব্যবসার ধারণা। সবসময় চিন্তা করতেন নতুন কিছু করার। অর্থের যোগানের জন্য দুই বন্ধু মিলে এ্যামিনেন্স এক্সেসরিজ কোম্পানি নাম দিয়ে গার্মেন্টস এক্সেসরিজের ব্যবসা শুরু করেন।
স্বপ্ন দেখতেন পড়াশোনা শেষ করে নিজের স্বপ্নের ব্যবসা শুরু করবেন তিনি। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন ছাত্র থাকাকালীন। এবং তারই প্রথম ধাপ গার্মেন্টস এক্সেসরিজের ব্যবসা। তিনি বলেন, কলেজের জীবনের এক বন্ধুর বাবার গার্মেন্টসে ফ্যাক্টরি সেকোটেক্স-এ ওভেন লেবেল সাপ্লাইয়ের কাজ দিয়ে ব্যবসার পথ চলা শুরু, সে সময়ে ওভেন লেবেলটা কী জিনিস সেটাই জানতাম না আমরা। ঢাকার বিভিন্ন মার্কেট ও অলিগলিতে ঘুরে সাতদিন পর সন্ধান পেলাম কাঙ্খিত সেই লেবেলের।
কিন্তু, ওভেন লেভেলের সন্ধান পেলেও ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অন্য সমস্যা। লেবেলের অর্ডার দিতে গেলে ব্যাংকে এলসি খুলতে হবে। কিন্তু এলসি খোলার গারেন্টার নেই আমাদের। দুই বন্ধু মিলে মতিঝিলে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত দেহে যখন বাসায় ফিরবো ঠিক তখন দেবতার আর্শিবাদ হয়ে সামনে আসলেন ওয়ান ব্যাংকের মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপক। এলসি’র গারেন্টার হলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত সেই ব্যক্তি। ৫ হাজার ৫০০ ইউএস ডলারের এলসি খুলতে সাহায্য করলেন তিনি।
কিন্তু ওই ব্যবসাও খুব বেশি দূর এগোয়নি তাঁদের। মাসুম নামে কাছের এক পরিচিত মার্চেন্ডাইজার প্রতারকের পাল্লায় পড়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খুঁইয়ে দিই দুইজন। এক্সেসরিজ এর ব্যবসার আগে ২০০৩-’০৪ সালের দিকে এ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপার ব্কস বানানো ও বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বিক্রি শুরু করেছিলাম আমরা। এজন্য পুরান ঢাকায় ঘুরে কাঠ দিয়ে বানিয়েছিলাম ফয়েল বক্স বানানোর মেশিন। তিনি বলেন, ব্যবসায় মূলধন কমছিল বলে আর হাতে বানানো মেশিনের ক্রটির কারণে ফয়েল বক্স বানানোর ব্যবসা ভেস্তে যায় খুব অল্প দিনেই ।
প্রিয় পাঠক, এখানেই থেমে যেতে পারতেন জসীম। কিন্তু থামেননি। পুরো নাম জসীম আহমেদ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র থাকার সময়েই ব্যবসার পথে যাত্রা শুরু। কুমিল্লা শহরের দক্ষিণচর্তার মৃত প্রকৌশলি আলী আহমেদের চার সন্তানের দ্বিতীয়জন তিনি। হোচট খেতে খেতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এখন তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের খ্যাতিমান জুতা প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান মাফ সুজ’র বাৎসরিক টার্নওভার হয় আড়াইশ কোটি টাকারও বেশি।
চট্টগ্রামের স্বনামখ্যাত শিল্পদ্যোক্তা আবু তৈয়ব’র তিন ছেলে মার্শাল, আবির ও ফয়সাল’র নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় ‘মাফ’ সুজ। জসীম বলেন, মার্শাল আমার বন্ধু। মূলত তাঁর অনুরোধেই মাফ সুজ-এ এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর পদে ২০০৯ সালে যোগ দেই আমি। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটি থাইল্যান্ডের ম্যানেজমেন্ট-এ থাকলেও ২০১২ সালে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার আগে এই প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক টার্নওভার ছিলো মাত্র ৩০ কোটি টাকা। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর গত অর্থবছরেই এই প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক টার্নওভার হয়েছে ২৭০ কোটি টাকা।
বন্ধুর কারখানা দেখার পাশাপাশি চট্টগ্রামের কালুরঘাটে গড়ে তুলেছেন আরজেএম ফুটওয়ার নামে একটি কারখানা। একই সাথে সেন্টমার্টিন দ্বীপে গড়ে তুলেছেন আধুনিক রেস্টুরেন্ট ‘উড়াল ভিউ’। তরুণ এই উদ্যোক্তা মনে করেন, একমাত্র তরুণ প্রজন্মই দেশের পরিবর্তন আনতে পারে। সেজন্য তরুণদের কাজ করবার জায়গাটি সহজ করতে হবে। দেশ পরিবর্তনের জন্য প্রশাসনিক ধ্যান-ধারণার আমূল পরিবর্তন জরুরি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, একটি ট্রেড লাইসেন্স করতে একজন তরুণকে যে পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় তা অস্বাভাবিক।
তিনি বলেন, প্রশাসনিক জটিলতা দূর করে তরুণদের জন্য ব্যবসাজগতে সহজ প্রবেশদ্বার সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে বিফল হবে। চট্টগ্রাম জুনিয়র চেম্বারের সাবেক সভাপতি জসীম আহমেদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন আঞ্চলিক শাখা ও মানবাধিকার কমিশনের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার আঞ্চলিক সমন্বয়কের।
চার ভাই-বোনের মধ্যে জসীম দ্বিতীয়। বড় বোন শামীমা আক্তার একটি কলেজের অধ্যাপক। ছোট ভাই কাউছার আহমেদ চিকিৎসক ও ছোটবোন জেরিন আক্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি মাস্টার্স সম্পন্ন করে এরাসমাস স্কলারশিপ নিয়ে বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগো-তে অধ্যয়নরত। প্রকৌশলী বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে জসীম আহমেদের শৈশব কেটেছে সিলেট ও নেত্রকোনায়।
১৯৮১ সালে সিলেটের মৌলভিবাজারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৮৫ সালে সুনামগঞ্জের একটি কে.জি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৯০ সালে ভর্তি হন নেত্রকোনার সরকারি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে লেখাপড়া করলেও ফের বাবার বদলি হওয়ায় ১৯৯৭ সালে এসএসসি পাশ করেন মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।
এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে এইচএসসি ও পরে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৬ সালে বিবিএ সম্পন্ন করেন তিনি। এর আগে ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ময়মনসিংহে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। বাবা-মা’র অনুরোধে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও বেশি দিন ভালো লাগেনি তার।
জসীম বলেন, নেত্রকোণায় থাকতে খেলাধুলার প্রতি খুব বেশি মনোযোগী ছিলাম। স্কুল ও এলাকার সহপাঠী বন্ধুদেরও নিয়ে সেই শৈশবে ৬ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন গড়ে তুলেছিলাম আইসিসি স্পোর্টিং ক্লাব যা এখন পিএসসি নামে পরিচিত। তিনি বলেন, সংগঠন করা এবং নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী আমি ওই ক্লাব থেকেই পেয়েছি। তিনি বলেন, জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাই ফেলনা নয়। যা দরকার তা হচ্ছে- ব্যর্থতা থেকে কোনো কিছু শিখা এবং তার পরে ব্যবহার করার ক্ষমতা অর্জন করা।
জালালউদ্দিন সাগর
তথ্যসূত্র: দ্যা ক্লিক ম্যাগাজিন ডটকম।