লোকমান হোসেন। বয়স ৫৫ পেরিয়েছে। বাড়ি পিরোজপুরের দূর্গাপুর। নাম দস্তখত লখিতে পারনে। ঢাকায় এসেছিলেন ২০ বছর আগে। সামান্য জীবিকার সন্ধানে। কিন্তু শুধু জীবিকা নয়, ভাগ্যে তার চেয়ে মিলেছিল বেশি কিছু। কারওয়ান বাজারে মাছ ওঠা-নামানোর শ্রমিক থেকে হয়ে উঠেছিলেন বড় এক হোটেলের মালিক। কিন্তু বিধিবাম; সেই মালিকত্ব তার কপালে আর সইল না।
ব্যবসায়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা না থাকায় প্রতিষ্ঠানে জ্বলে উঠলো লাল বাতি। যা তাকে হোটেল মালিক থেকে নামিয়ে দিল ফুটপাতে। লোকমান ১৯৯৭ সালে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে আসেন। জীবিকার তাগিদে শুরু করেন মাছ ওঠা-নামানোর কাজ। মাত্র ৬ মাস পর এ কাজ ছেড়ে দেন। শুরু করেন হোটেল ব্যবসা। প্রথমে ভাত আর এক ভাগে তরকারি দিয়েই শুরু। ছোট দুটি পাতিলে অল্প পরিসরে চলতে থাকে তার ব্যবসা।
কারওয়ান বাজারের ডিআইটি মার্কেটের ছোট একটি গলিতে বসতেন তিনি। মাছ বাজারের মুটে-মজুররা-ই ছিল তার কাস্টমার। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার ব্যবসার পরিধি। কাস্টমারের তালিকায় দিন মজুরের পাশাপাশি যোগ হন স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীরাও। পেটপুরে খাওয়ানোর বিনিময়ে তিনি নিতেন মাত্র ১০টাকা।
এভাবে চলতে থাকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। গত ৩ বছরের ব্যবসায় তার হাতে জমে গেল কয়েক লাখ টাকা। যে টাকায় তিনি স্বপ্ন দেখেন বড় একটি হোটেল দিবেন। ইচ্ছা অনুযায়ী তার দরজায় সুযোগও কড়া নাড়ল। কারওয়ান বাজারের ডিআইটি মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় একটি জায়গাও পেয়ে গেলেন। দেরি না করে জায়গার তত্বাবধায়ককে অ্যাডভ্যান্স হিসেবে দিলেন ৩ লাখ টাকা। আর আনুসঙ্গিক খরচ হিসেবে ২ লাখ টাকা হাতে রাখলেন।
২০০১ সালে শুরু হওয়া এ হোটেলের নাম দিলেন ‘খাঁজা হোটেল’। হোটেলে সাদা ভাত, বিরিয়ানি, কয়েক প্রকার মাছ ও মাংস, রুটি,পরাটা, মুংলাই ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকত। এক বছরের মধ্যে হোটেলের পরিধি এতোটাই বেড়ে গেল যে, তার একার পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়লো। তাই কর্মচারী নিয়োগ দিলেন ২৬ জন। ম্যানেজার নিয়োগ দিলেন ২ জন। এ সময়ে রোজ তার বেচা-কেনা হতো ২৫ হাজার থেকে ২৮ হাজার টাকা। যা থেকে রোজ ৩ হাজার টাকা দিতেন ভিট ভাড়া।
কিন্তু এ বর্ধিত ব্যবসা-ই হলো তার কাল। প্রয়োজনীয় শিক্ষা না থাকায় তা তিনি ধরে রাখতে পারলেন না। হিসাব সামলাতে না পেরে নিয়োগ করা দুই ম্যানেজারকে বুঝে দিলেন হোটেলের দায়িত্ব। হিসেবের দায়িত্ব অন্যের হাতে দেওয়ার কারণে পুরো হোটেলটা-ই চলে গেল অন্যের হাতে। হোটেলের দুই ম্যানেজার ফারুক ও মোস্তফা যুক্তি করে টাকা আত্মসাৎ করতে থাকে।
তারা দু’জন বিএ পাশ হওয়ায় টাকার হিসেব লোকমানকে গোজামিল দিয়ে বুঝিয়ে দিত। তারা একদিকে শ্রমিকের বেতন ও পণ্যের দাম বেড়েছে বলে। অন্যদিকে বেচা-কেনা কম হচ্ছে বলে জানাতো। এ টানা পড়েনের মধ্যে লোকমানের হোটেল ব্যবসা চলে ২০০৪ সাল পর্যন্ত। ব্যবসায় মাস শেষে যা থাকতো তা লোকমানের লোকসানেই ফেলতো। ফলে লোকমান ঋণ হতে শুরু করেন।
ব্যবসায় লোকসান গেলেও তার শ্রমিক ও জায়গা ভাড়া হিসেবে ২ লাখ টাকা মাসে দিতে-ই হতো। এভাবে প্রতিমাসে লোকসান গুণতে হলেও লোকমান নিজের হাতে গড়া ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ছাড়তে পারতেন না। কিন্তু ঋণের বোঝা বইতে গিয়ে তিনি আর শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। সব মায়া ত্যাগ করে হোটেল পজিশন বিক্রি করলেন ইউসুফ নামে এক ব্যক্তির কাছে।
নিজের জীবনের এ বিষাদময় কথাগুলো বলে একটি দীর্ঘ নি:শ্বাস নিলেন লোকমান। এরপর শুরু করলেন কীভাবে তার ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলেছে। তিনি বলেন, হোটেল ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর ম্যানেজার যেদিন বাড়ি যাবে, সেদিন হোটেল ক্যাশের নিচে ম্যানেজারের কাপড়ের ব্যাগে বড় অঙ্কের টাকা পাওয়া যায়। যা তার দুই মাসের বেতনের সমান।
বিষয়টি সন্দেহ জনক হওয়ায় খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি তারা গত ৩ বছরে বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে অনেক টাকা পাঠাতো। কাকরাইলে তাদের একজন দু:সম্পর্কের ভাই ছিল তার মাধ্যম। তারা অনেক টাকা আত্মসাৎ করেছে। কিন্তু তাদের আমি কিছু বলিনি। কারণ তাদেরকে আমার এলাকা থেকে পাঠিয়েছিল আমার-ই মেজ ভাই।
তাদের সম্মান নিয়ে চলে যেতে দিয়েছি। আর আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে বলেছি, আল্লাহ তুমি যদি আমার কপালে সুখ রাখ এ ফুটপাতেই রাখতে পার। তবে আমি আগের মতো গরিব-অসহায় ও স্বল্প মানুষের মাঝেই আমার জীবিকা খুঁজে পেতে চাই। সব হারিয়ে আমার এখন আফসোস নেই।
কারণ আমার দুটি সন্তান ও ছোট ভাইকে লেখা পড়া করাচ্ছি। ছোট ভাই অনার্স পড়ছে। বড় ছেলে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। ছোট মেয়ে নবম শ্রেণী পড়ছে। ওরা শিক্ষিত হলে-ই আবার এমন বড় প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবো। তখন ওদের পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাবে দুই তলার বড় হোটেল ব্যবসায়ী থেকে ফুটপাতে নামতে হবে না। যা আমার জীবনে হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, লোকমান বর্তমানে কারওরান বাজারের বিজিএমইএ ভবন সংলগ্ন ফুটপাতের ওপর আগের মতোই দুটি পাতিল নিয়ে খাবার বিক্রি করছেন। নিজ হাতে বেড়ে দিচ্ছেন ভাত। তার দোকানে আগের মতো-ই মুটে-মজুর, গরিব, অসহায় ও স্বল্প আয়ের মানুষ খেতে আসছেন। তবে এখন আর আগের মতো ১০ টাকায় পেট পুরে খাবার দিতে পারেন না তিনি। এখন ডিম ও ভাত ৩০ টাকা, ঈলিশ মাছ ও ভাত ৭০ টাকা এবং মহিশের মাংস ও ভাত ৯০টাকায় পেট পুরে খাওয়াচ্ছেন।
লোকমান জানান, ফুটপাতের এ ব্যবসা পরিচালনায়ও তাকে নিতে হয়েছে ৩ জন শ্রমিক। যাদের মাসিক ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা বেতন দিতে হচ্ছে। তবে তিনি তার জীবনে আর ব্যবসা বাড়াতে চান না, কারণ চুন খেয়ে গাল পুড়েছে দই দেখলে ভয় হয়। প্রয়োজনীয় শিক্ষা না থাকলে তিনি ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবেন না।
হোটেল মালিক থেকে ফুটপাতে নেমে আসার জন্য আফসোস হয় কী না জানতে চাইলে লোকমান বলেন, আফসোস তো হয়-ই, কিন্তু আফসোস করে কী করবো। আফসোস করলে আরও বুকের যন্ত্রণা বেড়ে যাবে। তাই দুঃখ না করে সন্তানদের লেখা-পড়া করানোর চেষ্টায় আছি। মগবাজরে বাসা নিয়েছি। যেখানে ছেলে-মেয়ে, ছোট ভাই ও সহধর্মিনী আছে। সুখের অতীতকে ভুলে ফুটপাতের ব্যবসায়ী হলেও এক প্রকার সুখে-ই আছি। তথ্যসূত্র: একুশে টিভি।