সুফি মিজানুর রহমানের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ছাত্র অবস্থায়। মাসিক ১০০ টাকা বেতনে নারায়ণগঞ্জে একটি জুট বেলি কোম্পানিতে করণিকের চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ব্যাংকের কর্মকর্তা হয়েছিলেন। ব্যাংকে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ৮০০ টাকা। দেশ স্বাধীনের পর লোভনীয় সেই চাকরি ছেড়ে দেন। হাতে থাকা ১ হাজার ৪৮৩ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
প্রথমবার এজেন্টের মাধ্যমে জাপান থেকে গাড়ির টায়ার আমদানি করে বিক্রি করলেন। লাভ শতভাগ। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সুফি মিজানুর রহমানকে। কাপড়, খাদ্য, যন্ত্রপাতি, গুঁড়া দুধ, তেল—যেটিই আমদানি করেন, সেটিতেই শুধু সাফল্যের দেখা পান। আমদানি বাণিজ্যে লাভ হলেও তাঁর স্বপ্ন ছিল অনেক বড়।
নব্বই দশকে বাণিজ্য থেকে পাওয়া মুনাফার টাকায় একের পর শিল্পকারখানা গড়েছেন। অংশীদার আলাদা হওয়ায় বড় ধরনের হোঁচটও খেয়েছেন। তবু নতুন করে একাই শুরু করেছেন। দুই দশকের মাথায় নতুন করে একের পর এক শিল্পকারখানা গড়ে তুলে ঠিকই আকাশছোঁয়া সাফল্যের দেখা পেয়েছেন। কঠোর পরিশ্রম আর সততা—এই দুটির ওপর ভর করে পেয়েছেন একের পর এক সাফল্য।
প্রায় ৪৯ বছর আগে মাত্র ১ হাজার ৪৮৩ টাকা দিয়ে যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, এখন তাঁর শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪। ঢেউটিন, ফ্লোট গ্লাস, কৃষি, মৎস্য, পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা কারখানা, টেক্সটাইল, জ্বালানি পণ্য, গাড়ি সংযোজনসহ ১১ খাতে ব্যবসা রয়েছে পিএইচপি পরিবারের।
পিএইচপি পরিবার এখন অনেক খাতেই নেতৃত্ব দিচ্ছে। জাহাজভাঙা শিল্পের দুর্নাম ঘুচিয়ে পরিবেশবান্ধব জাহাজ ভাঙার নেতৃত্ব এখন তাদের হাতে। দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিফলিত কাচশিল্পে ১ নম্বরে পিএইচপি। গাড়ি সংযোজন কারখানায়ও নেতৃত্ব দিচ্ছে এই পরিবার। ঢেউটিনশিল্পে শীর্ষ দুইয়ে আছে তাদের নাম।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ২০২০ সালে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে আয়ের দিক থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে এমন ২৩টি কোম্পানির তালিকায় পিএইচপির অবস্থান দেখানো হয় ১১তম। আর পিএইচপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গ্রুপের বার্ষিক লেনদেন এখন ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি।
ব্যবসা বাড়লেও কখনো ঋণখেলাপির তালিকায় ছিল না পিএইচপির কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম। ব্যাংকের টাকা সময়মতো শোধ করতে কখনোই পিছপা হননি। সুফি মিজানুর রহমানের সাফল্যের গল্প শুনতে নাসিরাবাদে তাঁর বাসায় বসে কথা হয়। আলাপকালে নিজের সাফল্যের চেয়ে বেশি বলেছেন পিএইচপি পরিবারের ১১ হাজার কর্মীর কথা। যাঁদের প্রত্যেককে নিজের পরিবারের সদস্য ভাবেন তিনি। তাঁর মতে, একসময় ব্যাংকের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে এখন ১১ হাজার পরিবারের কর্মসংস্থান করেছেন।
সুফি মিজানুর রহমানের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাঞ্চন গ্রামে। তাঁর বাবা সুফি মোহাম্মদ দায়েম উদ্দিনের কাপড়ের ব্যবসা ছিল। চট্টগ্রামে ব্যবসা শুরুর আগে ১৯৬৪ সালে মাসিক ১০০ টাকায় নারায়ণগঞ্জের জালাল জুট ভ্যালি কোম্পানিতে করণিকের চাকরি করতেন সুফি মিজানুর রহমান। নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে স্নাতকে পড়তেন তখন।
জালাল জুট ভ্যালিতে চাকরি করা অবস্থায় এক বন্ধু খবর দিলেন, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক) ‘জুনিয়র ক্লার্ক’ পদে লোক নেবে। পরীক্ষা দিলেন, উত্তীর্ণও হলেন। নিয়োগপত্র হাতে নিয়ে ব্যবসায়ী বাবার হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু বাবা খুশি হলেন না। বললেন, মাস্টার্স শেষ করলে আরও অনেক চাকরি পাওয়া যাবে। বাবাকে রাজি করাতে না পেরে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দ্বারস্থ হলেন তিনি। প্রধান শিক্ষক খুশি হলেন। ওই শিক্ষকই চাকরি করে পড়াশোনা করা যাবে বলে সুফি মিজানের বাবাকে বোঝালেন। শিক্ষকের কথায় রাজি হন বাবা।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে ‘জুনিয়র ক্লার্ক’ পদে ১৬৩ টাকা মাসিক বেতন-ভাতায় নিয়োগপত্র নিয়ে সুফি মিজানুর রহমান নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দেন চট্টগ্রামে। ১৯৬৫ সালের ১৯ মার্চ যোগ দেন ব্যাংকটির চট্টগ্রাম লালদীঘি শাখায়। অন্যদের চেয়ে কাজ বেশি করতে শুরু করলেন। চাকরিরত অবস্থায় ব্যাংকিং ডিপ্লোমাও করলেন ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স ইন পাকিস্তান থেকে।
১৯৬৫ সালে বিকমের ফলাফল ঘোষণা হয়। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজে ৪৬ জন বা ১৩ শতাংশ পাস করল। প্রথম শ্রেণিতে একজনও নেই। সবাই দ্বিতীয় শ্রেণি। এই তালিকায় ছিলেন সুফি মিজানুর রহমান। পাস করার পরই ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে (বর্তমানে পূবালী ব্যাংক) জুনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত করলেন।
চাকরি করা অবস্থায় ১৯৬৭ সালের ৪ জুলাই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। নারায়ণগঞ্জে বিয়ে হলো। বিয়ের এক মাস পর ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (বর্তমান পূবালী ব্যাংক) নিয়োগপত্র হাতে পান। কিন্তু বিপত্তি বাধল ব্যাংকের নিয়ম। তখন এক ব্যাংকের লোক আরেক ব্যাংকে যোগদান করতে পারত না। তবে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কর্মকর্তারা তাঁকে যোগদানের সুযোগ দিলেন।
১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে বর্তমান পূবালী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে যোগ দেন তিনি। বেতন মাসে ৮০০ টাকা। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানেও ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাপট। সুফি মিজানুর রহমান বাঙালি ব্যবসায়ীদের কম মার্জিনে পণ্য আমদানির সুযোগ করে দিতে থাকেন। তবে ব্যাংকের স্বার্থ ঠিক রেখে করতেন।
এ জন্য বিশ্ববাজারে দাম আর স্থানীয় বাজারের দাম পর্যালোচনা করতেন। একবার পাকিস্তান সরকার এক্সপোর্ট বোনাস স্কিমের আওতায় পণ্য রপ্তানি করলেই শুধু আমদানি করার সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সুফি মিজান বাঙালি ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার ব্যবস্থা করলেন। নিষেধাজ্ঞার আগের এক দিনে অস্বাভাবিক ঋণপত্র খোলার কারণে তদন্তও হয়েছিল। পার পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে ব্যবসায়ীদের কাছে বেশ আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন সুফি মিজানুর রহমান।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল। পাকিস্তানিদের ভয়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে পালাচ্ছে সবাই। সুফি মিজানুর রহমান ফটিকছড়ির নানুপুরে পীর হজরত শাহ্ সুফি সৈয়দ আবদুছ ছালাম ইছাপুরী (রহ.)-এর কাছে আশ্রয় নিলেন। তবে ১০ এপ্রিল পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দিল, ব্যাংকে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না। নানুপুরের হুজুরের কথায় যোগ দেন ব্যাংকে।
জুলাই-আগস্টের দিকে বন্দরে পণ্যের স্তূপ জমে যায়। বাঙালি ব্যবসায়ী যে কজন ছিলেন, তাঁদের অনেকে ব্যবসা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। বন্দরে পণ্য বেশি জমে থাকায় পাকিস্তান সরকার আদেশ দিল, পণ্য খালাস না করলে ব্যাংক তা বিক্রি করে টাকা নগদায়ন করবে। অনেক ব্যাংক তাই করল।
সুফি মিজানুর রহমান তখন ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ আমির মার্কেট শাখায় কাজ করতেন। তিনি আদেশ নিয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের কাছে গেলেন। বললেন, পণ্য ব্যাংকের জিম্মায় গুদামে রাখতে চান। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক সায় দিলেন তাঁর কথায়। চট্টগ্রামে ১৮টি গুদাম ভাড়া নিয়ে বন্দর থেকে পণ্য এনে রাখা হলো।
এই ১৮টি গুদামের চাবি কোমরে বেঁধে রাখতেন তিনি, যাতে কোনো পণ্য খোয়া না যায়। এটা খুবই গোপনে করা হলো। ব্যবসায়ীরা ভেবেছেন, তাঁদের সব পণ্যই বিক্রি করে দিয়েছে ব্যাংক। দেশ স্বাধীনের পর এসে ব্যবসায়ীরা দেখেন, তাঁদের মাল গুদামে রয়ে গেছে। সবাই সুফি মিজানকে কোলে তুলে আনন্দ-উল্লাস করতে থাকলেন। তাতে ব্যবসায়ীদের কাছে সুফি মিজানুর রহমান আরও বেশি আপন হয়ে গেলেন।
ব্যাংকে আমদানি-রপ্তানির কাজ করতে গিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। সম্পর্ক তৈরি হয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও। স্বাধীনতার আগে বাঙালি ব্যবসায়ীদের সংখ্যা এমনিতেই ছিল কম। স্বাধীনতার পর পালিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানিরাও। বাজারে তখন পণ্যের চাহিদা ব্যাপক, তার তুলনায় আমদানিকারক কম।
ব্যাংকের বৈদেশিক শাখায় কাজ করার সুবাদে কোনো পণ্যের আমদানিতে কখন কেমন লাভ হতে পারে, তা জানতেন তিনি। এই অভিজ্ঞতা দিয়েই দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন সুফি মিজানুর রহমান। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিলেন। বাবার পরামর্শও ছিল—ব্যবসা জানলে টাকা তোমার পেছনে দৌড়াবে। ব্যবসা করলে মানুষের চোখের পানি মুছিয়ে দিতে পারবে।
সে সময় বাজারে জাপানের ব্রিজস্টোন টায়ারের ব্যাপক চাহিদা। তাই প্রথম ব্যবসা হিসেবে বেছে নিলেন টায়ার-টিউব আমদানি। সমস্যা হলো, সে সময় ব্রিজস্টোনের একমাত্র এজেন্ট ছিল ইস্টার্ন মোটরস লিমিটেড। ব্রিজস্টোনের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ইস্টার্ন মোটরস বাইরের কোনো ব্যবসায়ীকে সরাসরি আমদানির সুযোগ দিতে পারে না। এখানেও ভাগ্য সহায় হলো।
কারণ, সুফি মিজানুর রহমান ব্যাংকে চাকরি করার সময় ইস্টার্ন মোটরসের প্রতিষ্ঠাতা নুরূল ভূঁইয়ার ছেলে মতিউর রহমানসহ (উত্তরা মোটরস লিমিটেডের চেয়ারম্যান) তিন সন্তানকে পড়াতেন। সে সুবাদে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। মুনাফার অর্ধেক ভাগাভাগি করতে হবে এমন শর্তে ইস্টার্ন মোটরস পরোক্ষভাবে আমদানির সুযোগ দিল।
ব্যাংকও শূন্য মার্জিনে ঋণপত্র খুলে দিল। টায়ার বিক্রি করে প্রথম ব্যবসায় ভালো মুনাফা হলো। প্রথমেই ব্যাংকের টাকা শোধ করলেন তিনি। এরপর একের পর এক পণ্য আমদানি শুরু করলেন। জার্মানি, ডেনমার্ক কিংবা হল্যান্ড থেকে গুঁড়া দুধ, চীন থেকে স্টেশনারি ও সুতা, ব্রাজিল থেকে চিনি, ভারত ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি করতে থাকলেন।
আমদানি শুরুর পর লাভের টাকায় ঢাকার মৌলভীবাজারে দোকান কিনে নেন তিনি। এতে অংশীদার হন সহধর্মিণী তাহমিনা রহমানের বড় ভাই ও বাল্যবন্ধু মোহাম্মদ রুকুনউদ্দিন মোল্লা। সুফি মিজানুর রহমান চট্টগ্রাম থেকে পণ্য কিনে ঢাকার মৌলভীবাজারে পাঠাতেন। সেখানে বসে বিক্রি করতেন বাল্যবন্ধু।
গুরুজনদের কথা খুব মানতেন সুফি মিজানুর রহমান। তাঁরা বলতেন, মানুষকে সহায়তা করতে হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন, বাণিজ্য থেকে লাভের টাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন করবেন। এক দশক পণ্য আমদানি ও বেচাকেনা করে হাতে অনেক টাকা তখন। সে সময়টা বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা শিল্পকারখানায় পা রাখতে শুরু করেছিলেন। এই তালিকায় নাম লেখান তিনিও।
বাল্যবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে শুরু করলেন জাহাজভাঙা কারখানা। সীতাকুণ্ডের উপকূলে বঙ্গোপসাগরের তীরে আর এম শিপব্রেকিং নামে জাহাজভাঙা কারখানা গড়ে তুললেন। ১৯৮২ সালে ছয় লাখ ডলারে ‘ওশান এইচ’ নামে ছয় হাজার টনের পুরোনো জাহাজ প্রথম আমদানি করে ভাঙলেন কারখানায়। প্রথম আমদানি করা জাহাজ ভেঙেও পেলেন লাভের দেখা।
দুই বছর পর জাহাজভাঙা কারখানায় লোহার প্লেট থেকে রড তৈরির কারখানাও দিলেন। নাম দিলেন সিনো বাংলা রি-রোলিং মিলস। মাসে ৪০০ টনের উৎপাদন ক্ষমতা। এ কারখানায়ও লাভের দেখা মিলল শুরুতে। এরপর কারখানা স্থাপনের নেশা পেয়ে বসল। মোংলা ইঞ্জিনিয়ার্স নামে বিলেট কারখানা দিলেন ১৯৮৪ সালে। এরপর একে একে গড়ে তুললেন ঢেউটিন, ভোজ্যতেল ও সুতার কারখানা। মূলত ঢাকায় এসব কারখানা গড়ে তোলেন।
প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন আর এম নামে। অংশীদারের নাম ও নিজের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে গ্রুপের নাম হলো। শুরুতে জাহাজভাঙা ছাড়া সব কারখানা ঢাকাতেই ছিল। ঢাকায় একের পর এক কারখানা গড়ে তুলতে দেখে সহধর্মিণী চট্টগ্রামে শিল্পকারখানা করার পরামর্শ দিলেন। তাঁর কথায় ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দিলেন ঢেউটিন তৈরির কারখানা—সি আর কয়েল মিলস।
ব্যবসা বড় হচ্ছে। এ সময়ে নিজের কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা আরএম গ্রুপ ভাগ হয়ে গেল। তখন গ্রুপের হাতে ছিল ১০টি শিল্পকারখানা ও ২টি প্রতিষ্ঠান। বেশির ভাগই ঢাকায়। ভাগে পাঁচটি ঢেউটিন কারখানার একটিও পড়েনি। সুফি মিজানুর রহমানের ভাগে পড়ল জাহাজভাঙা কারখানা, অক্সিজেন কারখানা ও রাবার বাগান।
ভাগে পাওয়া প্রতিষ্ঠান নিয়ে ১৯৯৯ সালের ২২ জুলাই তিনি গঠন করলেন আলাদা কোম্পানি। নাম দিলেন পিএইচপি। প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা নয়, এই পিএইচপির অর্থ সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। এবার নিজেই নতুন করে শুরু করলেন। সঙ্গে ছিল শিল্পকারখানার অভিজ্ঞতা। নতুন নামে যাত্রা শুরুর পর পিএইচপির নামে প্রথম প্রতিষ্ঠান ছিল পিএইচপি গ্যালভানাইজিং ইন্ডাস্ট্রি।
শিল্প দাঁড় করাতে সে সময় কারখানায় দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। এমনও দিন গেছে, একটানা ১৫ দিন কারখানাতেই পড়ে ছিলেন তিনি। এবার আগের মতো ছোট কারখানা নয়, বড় বিনিয়োগে কারখানা করতে থাকলেন। পিএইচপির হাত ধরে ২০০৫ সালে দেশে প্রথম প্রতিফলিত কাচের বড় কারখানা ‘পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রি’ গড়ে তোলা হয়।
পুরোনো ঢেউটিন তৈরির কারখানার পাশাপাশি ফেনীতে আড়াই লাখ টন উৎপাদন ক্ষমতার নতুন কারখানা গড়ে তোলা হয়। আবার ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ার প্রোটন ব্র্যান্ডের গাড়ি সংযোজন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে পিএইচপি। পিএইচপির এই তিনটি পণ্যই বাজারে শীর্ষ সারিতে রয়েছে।শুধু নিজেরাই কারখানা দিলেন না, রুগ্ণ প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করে লাভজনক করে তুললেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের পৈতৃক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল অর্ধশত বছরের বেশি পুরোনো ইব্রাহিম কটন মিল। লোকসানি প্রতিষ্ঠানটি সুফি মিজানুর রহমানের হাতে এসে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা শিল্পকারখানার জন্য দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে পিএইচপি।
সুফি মিজানুর রহমানের নিজের গড়া জাহাজভাঙা কারখানা প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০২০ সালে দেশে এই কারখানার জন্য পেয়েছেন মেরিটাইম অ্যাওয়ার্ড। পরিবেশবান্ধব ঢেউটিনের জন্যও সুনাম অর্জন করেছে পিএইচপি। গাড়ি সংযোজন থেকে ধাপে ধাপে দেশেই ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি উৎপাদনের দিকে যাচ্ছে এই শিল্প পরিবার।
২০২০ সালে করোনার ধাক্কা পিএইচপি পরিবারেও লেগেছে। করোনার সময়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। তবু করোনার কারণে একজন কর্মীকেও ছাঁটাই করেনি এই শিল্প পরিবার। সুফি মিজানুর রহমান তখন ঘোষণা দিলেন, করোনায় কাউকে ছাঁটাই করা হবে না। অপরাধ করলেও করোনার পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কথার প্রমাণ দিলেন কাজে।
ছাঁটাই তো হয়ইনি, উল্টো করোনার সময় ১২টি বোনাস দিয়েছেন কর্মীদের। মাস শেষ হওয়ার আগের দিন বেতন-ভাতা তুলে দিয়েছেন। সুফি মিজানুর রহমান বলেন, মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি। ঝড় মোকাবিলা করে মানুষ এগিয়ে যাবে। চিরদিন ঝড় থাকবে না। পিএইচপি পরিবারের সদস্যদের (কর্মী) মনোবল চাঙা রাখার জন্যই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সুবিধা দিয়েছি।’
২০০৯ সালে চট্টগ্রামের এস আলম, কেডিএস, পিএইচপি ও এবিসি গ্রুপ মিলে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় মৌলিক ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেপস (বিডি) লিমিটেড নামে যৌথ মালিকানার কোম্পানির নিবন্ধন নেওয়া হয়। তবে এই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। যৌথ উদ্যোগ ভেস্তে গেলেও সুফি মিজানুর রহমান স্বপ্ন লালন করে রেখেছেন।
ওই উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার এক দশক পরে এবার নিজে একাই মৌলিক ইস্পাত কারখানার উদ্যোগ নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫০০ একর জায়গায় মৌলিক ইস্পাত কারখানা (এইচআর কয়েল তৈরি) গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। ২০২৩ সালে জায়গা বুঝে নেবে পিএইচপি। নির্মাণ শুরু হবে ২০২৬ সালে।
সম্ভাব্য বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদনে যাবে ২০৩০ সালে। কারখানায় সম্ভাব্য উৎপাদনক্ষমতা হবে ৩০ লাখ টন। ঢেউটিন তৈরির এইচআর কয়েল, সিআই শিট, রড, ফ্রিজ-গাড়ির পাতের মতো বহু পণ্য উৎপাদিত হবে এই কারখানায়। কয়লা ও খনির আকরিক ব্যবহৃত হবে কাঁচামাল হিসেবে।
সুফি মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে মৌলিক ইস্পাত কারখানা নেই। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই। দেশের গর্বের প্রতিষ্ঠান হবে মিরসরাইয়ের কারখানা। ব্যবসায় সাফল্যের পাশাপাশি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন সুফি মিজানুর রহমান। ২০২০ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় শিল্পপতি হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক। ৭৮ বছর বয়সেও কঠোর পরিশ্রম করেন।
কঠোর পরিশ্রম, সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস ও কাজে একাগ্রতা থাকলে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস তাঁর। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ দিনে আট ঘণ্টা পরিশ্রম করে। অসাধারণ হতে হলে ১৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হবে। না হলে সাফল্যের দেখা মিলবে না। সুফি মিজানুর রহমানের সাত ছেলে, এক মেয়ে। বিদেশে পড়াশোনা শেষে দেশে এসে সাত ছেলে বাবার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর হাল ধরেছেন। বাবার কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা পিএইচপি পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরাও। তথ্যসূত্র: প্রথমআলো।