1. editor@islaminews.com : editorpost :
  2. jashimsarkar@gmail.com : jassemadmin :

জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা!

জার্মানিতে এসেছি প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল। চোখের পলকে জীবনে একটা প্রত্যাশিত পরিবর্তন চলে এল। আসার পথে বিমানে কয়েকবার কেঁদেছিলাম এই ভেবে যে, সবকিছু ফেলে আমি কোথায় চলে যাচ্ছি! প্রিয় মানুষ, প্রিয় দেশ থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা অতটা সহজ নয়। এখানে ঘুম ভাঙে পরীক্ষা-ল্যাব কিংবা অন্যান্য বহু টেনশনে। এখানে মায়ের হাতের রান্না নেই, প্রিয় শহরের প্রাণবন্ততা নেই, টং-এর চা নেই, নেই ভাঙা রাস্তা আর গাড়ির ধোঁয়ার মাঝে একরাশ প্রশান্তি। এত নেই-এর মাঝে শুধু আছে স্বপ্ন পূরণের তৃপ্তি। হয়তো এই তৃপ্তির জন্যই বর্তমানে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ আমার মতো দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন।

স্বপ্ন হবে না কেন? আমাদের দেশের মেধাবীরা যখন ছোটবেলা থেকেই বুয়েট, মেডিকেল কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন লালন করে বড় হয় তখন আন্তর্জাতিক পরিসরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থানও বেশ নাজুক। আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ২০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও আমাদের স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানগুলো নেই; আসলে এই র‌্যাঙ্কিং দিয়ে কি বোঝায়? র‌্যাঙ্কিংগুলো আসলে করা হয় মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা এবং এই গবেষণার ফলাফল বিশ্বের অগ্রগতিতে কেমন ভূমিকা রাখছে তার ওপর। অতএব র‌্যাঙ্কিং এটিই বলে দিচ্ছে বৈশ্বিক অগ্রগতিতে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা বেশ নাজুক। এ ছাড়া পাস করার পর চাকরির টেনশনে অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েটের মাথার চুল পড়ে যায়। সবকিছু মিলিয়ে নিজের যোগ্যতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য পেশাগত দক্ষতা অর্জন, বিশ্ব সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি, দেশের কর্মক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া, সর্বোপরি নিজের জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিদেশে পড়তে আসা বর্তমান শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রধান স্বপ্ন। তবে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীরা আসতে পারে না কারণ তারা মনে করে বিদেশে মাস্টার্স-পিএইচডি এই সব হলো অন্য গ্রহের এলিয়েন কিংবা অতীব মেধাবীর কাজ, এটা তাদের দিয়ে সম্ভব হবে না। কিন্তু এটা সকলকে দিয়েই সম্ভব যদি ইচ্ছে ও সঠিক দিকনির্দেশনায় অগ্রসর হওয়া যায়।

তবে যাব বললেই আসা যাবে না। প্রিয় মাতৃভূমি ছাড়ার আগে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করতে হয়। যেমন পছন্দের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণযোগ্যতা, স্কলারশিপ, টিউশন ফি, গবেষণার সুযোগ, ভবিষ্যৎ চাকরির বাজার, জীবনযাত্রার খরচ, আবহাওয়া (ছবি পাগলরা সুন্দর সুন্দর ছবি তোলার স্থানও বিবেচনা করে) ইত্যাদি। সবকিছু বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপ শিক্ষার্থীদের পছন্দের জায়গা। একেক দেশে একেক রকম সুযোগ-সুবিধা কিংবা অসুবিধা আছে। যেমন আমার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর কনভিন্সড হয়েছিলেন ফান্ডিংসহ। কিন্তু GRE দিতে হবে ভর্তির জন্য। আমি অলস প্রজাতির হওয়ায় এই পেইন নিতে পারিনি। আবার কানাডায় রিসার্চের সুযোগ হয়েছিল, কিন্তু কবে নাগাদ আমাকে প্রফেসর নিতে পারবেন ওটা নিশ্চিত করে বলতে পারছিলেন না। আমিও আর ধৈর্য ধরিনি, জার্মানিতে সুযোগ পাওয়ামাত্র উড়াল দিলাম। তাই জার্মানিতে আসার বিভিন্ন দিক আমার অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরছি। সকল তথ্য শতভাগ ধ্রুব নয়; স্থান, কাল, পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হতে পারে।

কেন জার্মানি আসবেন? একেক জনের কাছে জার্মানি একেক কারণে উত্তম। প্রথম কারণ হলো জার্মানির শিক্ষার মান। সারা পৃথিবীতেই জার্মান ডিগ্রির কদর রয়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য জার্মানিকে স্বর্গ বলা চলে। বিশ্ববিখ্যাত অনেক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জন্ম জার্মানিতেই। এ পর্যন্ত ১০৩টি নোবেল জার্মানদের পকেটে ঢুকেছে যা বিশ্বে তৃতীয়। এ ছাড়া জার্মানির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো এখানে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি নেই। অর্থাৎ আপনি ফ্রিতে পড়তে পারবেন। এখানে সামাজিক নিরাপত্তা বেশ ভালো। অর্থনৈতিকভাবেও জার্মানি বেশ শক্তিশালী। ইউরোপের প্রথম ও বিশ্বের চতুর্থ পরাশক্তি হলো বর্তমানে এঙ্গেলা ম্যার্কেলের নেতৃত্বাধীন দেশটি। তাই পড়াশোনা শেষে স্থায়ী চাকরি অথবা বসবাসের জন্য এই দেশটি খারাপ পছন্দ নয়। এ ছাড়া আরেকটি চমকপ্রদ বিষয় হলো এখানকার স্টুডেন্ট ভিসা দিয়ে আপনি ইউরোপের ২৬টি দেশে গবেষণার সুযোগ তৈরি করতে পারবেন, সেই সঙ্গে ইউরোপে ঘোরাঘুরির সুযোগ তো আছেই। তাই সবকিছু মিলিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে সহজে তৈরি করতে জার্মানিতে শকুন দৃষ্টি দিতে পারেন।

কি পড়তে পারবেন জার্মানিতে? মোটামুটি সবই পড়তে পারবেন এখানে। জার্মানিতে ব্যাচেলরস, মাস্টার্স, ডক্টরাল ও পোস্ট-ডক্টরাল ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া ডিপ্লোমা করারও ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো মাস্টার্স বা পিএইচডির দিকে নজর দেওয়া। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামগুলোতে পড়তে আসলে জার্মান ভাষায় পারদর্শিতা প্রয়োজনীয়তা নেই, ইংরেজিই যথেষ্ট। ২০১৬ সালে সব মিলিয়ে ১২৫৮টি বিষয় অফার করা হচ্ছে যা সম্পূর্ণ ইংরেজিতে; এর মধ্যে ৯০টি ব্যাচেলরস, ৭২২টি মাস্টার্স প্রোগ্রাম উল্লেখযোগ্য (প্রতিবছরই বিষয়ের সংখ্যা বাড়ছে)। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বছরে দুটি সেমিস্টারে ভর্তির সুযোগ থাকে। গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন ও অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীতকালীন সেমিস্টার। গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারের জন্য আবেদন করতে হয় ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ও শীতকালীনের জন্য জুন-জুলাই মাসে। ব্যাচেলরস ডিগ্রি তিন-চার বছর ও মাস্টার্স ডিগ্রিসমূহ সাধারণত দুই বছর মেয়াদি; ফাঁকিবাজ হলে আড়াই-তিন বছরও লাগতে পারে পাস করতে। তবে অধিকতর ফাঁকিবাজ হলে সোনার বাংলার টিকিট ধরিয়ে দেবে।

এবার সবচেয়ে দরকারি কথায় আসি অর্থাৎ কীভাবে জ্বালাবেন স্বপ্নের প্রদীপ! আপনার কেমন যোগ্যতা থাকলে আপনি জার্মানির বুকে বাসা বাঁধতে পারেন সেটাই ব্যাখ্যা করব তবে আমি মাস্টার্সের বিষয়ে ফোকাস করছি।। ১। বাইরে পড়তে আসার স্বপ্ন তদুপরি জার্মানিতে পড়তে আসার স্বপ্ন। ২। স্বপ্ন বাস্তবায়নে পরিশ্রম করার মানসিকতা। ৩। নিজে নিজে অ্যাপ্লাই করা হতে শুরু করে জার্মানিতে এসে রান্না করার মানসিকতা। ভুলেও ভাববেন না কিছু টাকা খরচ করে এজেন্সির মাধ্যমে চলে যাব। এজেন্সির মাধ্যমে জার্মানি আসা প্রায় অসম্ভব। তাই নিজে কাগজপত্র তৈরি করা হতে পুরো পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত হোন, তবে কাজগুলো অতটা কঠিন কিছু নয়।

৪। শিক্ষাগত যোগ্যতা: আপনি ব্যাচেলরে আসতে চাইলে ১২ বছর শিক্ষা অভিজ্ঞতা লাগবে এবং মাস্টার্সের জন্য ব্যাচেলর ডিগ্রি। অনেকে মনে করেন সিজিপিএ ৪ অথবা ৩.৮ না পেলে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে পারব না! এ কথা সত্য হলে বোধ হয় আমার আসা হতো না। আসলে সিজিপিএ ৩.৫ পেলেই বেশ ভালো। তবে ৩–এর ওপরে থাকলেই মোটামুটি সেফ বলা যায়। ৩–এর নিচে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে আসা সম্ভব যদি অন্যান্য যোগ্যতাসমূহকে বেশ শক্তিশালী করা যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশে কোথায় পড়ছেন সেটাও ভাবার দরকার নাই, কারণ তারা আমাদের পাবলিক-প্রাইভেট কিছুই চেনেন না। daad.de এই ওয়েবসাইটটি জার্মানির উচ্চশিক্ষার বাইবেল। এই ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার পছন্দের বিষয় খুঁজে নিতে পারেন অনায়াসে, সাবজেক্টের সঙ্গে প্রয়োজনীয় বাকি সকল তথ্য যেমন আবেদনের প্রক্রিয়া, যোগ্যতা, ডেডলাইন ইত্যাদি ওয়েবসাইটেই দেওয়া থাকবে।

৫। ইংরেজি ভাষার দক্ষতা: জার্মানিতে আসতে হলে অবশ্যই IELTS দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্কোর ৭–এর টার্গেট রাখা ভালো যাতে ৬.৫–এর নিচে স্কোর না নামে এবং কোনোভাবেই যেন ৬–এর কম না হয়। IELTS–এর ভয়ে অনেকের বাইরে আসার স্বপ্ন শেষ হয় যায়। আসলে একটু একটু করে কয়েক মাস প্রস্তুতি নিলে IELTS–এর বাধাটি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারবেন। আমি হঠাৎ করে দিয়ে একবার পুরাই ধরা, ২০ দিনের মাথায় আবারও দিলাম। তাই অযথা টাকা নষ্ট না করে একবারে ঝামেলা শেষ করলে ভালো। কিছু জায়গায় TOEFL গ্রহণ করবে আবার স্পেশাল কিছু বিষয়ের জন্য GRE আবদার করতে পারে তাই বুঝে শুনেই বিষয় বাছাই করবেন।

৬। মোটিভেশন লেটার: জার্মানিতে ভর্তির জন্য একটা গুনগানপত্র প্রয়োজন হবে একেই মোটিভেশন লেটার বলে। এই পত্রের মাধ্যমে আপনি মূলত নিজের গুনগান গাইবেন। যিনি এই লেটার পড়বেন তাকে বোঝাতে হবে আপনি কেন যোগ্য, কেন ভর্তির জন্য আবেদন করছেন, এই শিক্ষা আপনার ভবিষ্যতের জন্য কীভাবে কাজে লাগবে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন পড়তে চান, জার্মানিতেই কেন আসবেন ইত্যাদি। আপনার অতীত অভিজ্ঞতা/পুরস্কার ইত্যাদি বলতে পারেন। উপরোক্ত বিষয়গুলো লেখার সময় অবশ্যই আপনার সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্যারিয়ার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা উচিত। মোটিভেশন লেটার সাধারণত দুই পৃষ্ঠার মধ্যেই লিখতে হয়, কখনো এক পৃষ্ঠা যথেষ্ট। সবশেষে, কোনোভাবেই কপি পেস্ট করবেন না, ধরা পড়লে আপনার আবেদনই বাতিল হয়ে যেতে পারে।

৭। রিকোমেন্ডশন লেটার: অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে রিকোমেন্ডশন লেটার চাইতে পারে। এটি হলো আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাকে চেনে জানে এমন শিক্ষকের সুপারিশপত্র। আপনার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, আপনার প্রজেক্ট কিংবা থিসিস সুপারভাইজার অথবা অন্য যে কোনো শিক্ষকের (Professor/Associate Professor হলে ভালো) থেকে এটি সংগ্রহ করতে পারেন যেখানে আপনার যোগ্যতা, দক্ষতা অথবা ভালো দিকগুলো উল্লেখ থাকবে। সেইসঙ্গে আপনার সীমাবদ্ধও লেখা যেতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে এটি পড়ে যেন মনে না হয় কপি পেস্ট করেছেন অথবা যেন মনে না হয় আপনার প্রফেসর আপনাকে না জেনেই প্রশংসাপত্র দিয়েছেন। রিকোমেন্ডশন লেটার সাধারণত ২/৩টি যথেষ্ট।

৮। পাবলিকেশন ও অন্যান্য: এই বিষয়টা খুব বেশি তাৎপর্যপূর্ণ না হলেও প্রতিযোগিতায় আপনাকে অনেকখানি এগিয়ে রাখবে। সায়েন্টিফিক পাবলিকেশন খুব বেশি দরকার। অনার্সের তৃতীয় বর্ষ থেকে যদি কোনো রিসার্চের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যায় তবে পাস করার আগেই দু-একটি পাবলিকেশন হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের পুরস্কার, ভলান্টিয়ার অভিজ্ঞতা, সায়েন্টিফিক সেমিনারে অংশগ্রহণ ইত্যাদি আপনার সিভিকে (Curriculum Vitae/RESUME) বেশ চমকপ্রদ করবে এবং অন্য প্রতিযোগী হতে আপনি বেশ এগিয়ে থাকবেন। যাদের CGPA একটু কম তাদের জন্য ভালো IELTS–এর পাশাপাশি এই সবই প্লাস পয়েন্ট। ওপরের সবকিছু মিলিয়ে একটা আকর্ষণীয় CV বানাতে হবে। বেশ সময় নিয়ে নিজে তৈরি করবেন ও পরে সিনিয়র কাউকে দিয়ে রিভিউ করিয়ে নিন। অলসতা করে ইন্টারনেটের ফরম্যাটে নিজের নাম বসিয়ে কাজ সেরে ফেলবেন না। মনে রাখবেন, শর্টকাট মানেই বিপদ।

৯। সঠিক তথ্য ও সঠিক পরিকল্পনা: এটি আপনার অন্য সব কিছুকে মূল্যায়ন করবে। যেখানে আবেদন করবেন তার রিকোয়ারমেন্টস ভালো করে বুঝে নিন, ডেডলাইন ডাবল চেক করুন, কোন ডকুমেন্ট কেমন করে চাইছে অর্থাৎ নোটারি কিংবা অন্য কোনো রকম সত্যায়ন দরকার আছে কিনা ভালো করে দেখে নিন। অ্যাপ্লাই করার পদ্ধতিও বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে আলাদা, সেটিও মাথায় রাখতে হবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি আবেদন করা যায় কোথাও আবার Uni-assist এর মাধ্যমে অ্যাপ্লাই করা। এ ছাড়া ভিসার জন্য আবেদন করা, ভিসা পাওয়া এবং জার্মানিতে আসা অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক কাজ করা প্রয়োজন। তাই প্রতিটি কাজই পরিকল্পনা করে করবেন, সরকারি ছুটির দিন মাথায় রাখবেন। যেকোনো কনফিউশন থাকলে অবশ্যই পরিচিত যারা জার্মানি গিয়েছে তাদের কাছে জানতে চান, ফেসবুকে এই সংক্রান্ত গ্রুপ আছে ওখানে জিজ্ঞেস করুন। সবাই আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। সিনিয়রদের কাছে আমি নিজেও অনেক কৃতজ্ঞ, ওনারা না থাকলে কত ঝামেলায় পড়তাম ওপরওয়ালা জানেন।

১০। প্রবল ধৈর্য! হেরে যাওয়া যাবে না। পুরো পথে ছোটখাটো অনেক সমস্যা আসবে, কোনো কিছুতেই থেমে যাওয়া যাবে না। মনে রাখবেন, আপনি জার্মান সরকারের টাকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসবেন, বাপের টাকায় নয়। তাই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে জার্মানিতে পা রাখার আগ পর্যন্ত। রেস্টুরেন্টে প্রিয় মানুষের জন্য যেভাবে অপেক্ষা করেন তেমন করেই প্রবল ধৈর্য ও অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করুন প্রথমে অ্যাডমিশন লেটার ও পরে ভিসার জন্য। এরপরেই ডয়েচল্যান্ডের টিকিট।

অ্যাডমিশন লেটার পেয়ে গেলে কাজ অনেকখানি শেষ, এরপর ভিসার আবেদন। জার্মানিতে ভিসা পেতে হলে অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে অন্যতম প্রধান শর্ত হলো ব্লক অ্যাকাউন্ট। জার্মানিতে আসার আগেই জার্মানির একটি ব্যাংকে ৮০৪০ ইউরো (বাংলাদেশি টাকায় সাত লাখের একটু বেশি) ব্লক করতে হয়। এটি আসলে সিকিউরিটি মানির মতোই অর্থাৎ জার্মানিতে এসে নিজের থাকা খাওয়া খরচ মিটানোর মতো টাকা আছে এমন প্রমাণ। এই অ্যাকাউন্ট থেকে আপনি প্রতি মাসে ৬৭০ ইউরো তুলতে পারবেন এবং এক বছর পর পুরো টাকাই দেশে পাঠিয়ে দিতে পারবেন (খরচ না করলে)। কোনো কারণে জার্মানি আসতে পারলে চিন্তার কারণ নেই, এই টাকা জার্মান ব্যাংক আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবে।

কেমন খরচ পড়বে? আগেই বলেছি জার্মানিতে পড়তে কোনো টাকা দেওয়া লাগবে না। তবে সেমিস্টার শুরুর আগে বিশ্ববিদ্যালয় অনুযায়ী ১৫০-২৫০ ইউরো পর্যন্ত এনরোলমেন্ট ফি দেওয়া লাগে। তবে মজাটা হলো এই ফির বিনিময়ে আপনাকে একটা কার্ড দেবে যেটা দিয়ে আপনি পুরো স্টেটে (কোথাও কিছু শহর) ফ্রি যাতায়াত করতে পারবেন। এর মানে এখানে গাড়ি ভাড়ার কোনো খরচ নেই। এ ছাড়া প্রতি মাসে হেলথ ইনস্যুরেন্সের জন্য টাকা দিতে হবে এবং জার্মানিতে থাকা পর্যন্ত সকল চিকিৎসা ব্যয় তারাই বহন করবে অর্থাৎ স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। থাকা খাওয়া, বাসা ভাড়া শহর অনুসারে ভিন্ন (যেমন ঢাকা-চট্টগ্রামের জীবনধারণ খরচ যশোর-মাগুরার জীবনধারণের খরচ অপেক্ষা বেশি)। তবে সব খরচ যোগ করলে বড় শহরে ৫০০–৬০০ ইউরো এবং ছোট শহরে ৪০০–৫০০ ইউরোর বেশি লাগবে না। আপনার খরচ আপনার লাইফস্টাইলের ওপর; অনেকে ৪০০ ইউরো দিয়েই এইখানে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করছেন। (বলে রাখা উচিত বর্তমানে ১ ইউরো সমান প্রায় ৯০ টাকা)।

স্কলারশিপ ও ফান্ডিং কি আছে? টাকা কীভাবে জোগাড় হবে? জার্মানিতে আসার জন্য যে দুটি স্কলারশিপ আছে আছে তা হলো DAAD ও Erasmus Mundus স্কলারশিপ। যতটুকু জানি DAAD–এর জন্য আপনাকে অবশ্যই চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। Erasmus Mundus–এর ব্যাপারে ইন্টারনেটে খোঁজ নিতে পারেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অল্প কিছু স্কলারশিপ দেওয়া হয়; দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকে আবেদন করা যায় এসব ফান্ডিংয়ের জন্য। এখানে রিসার্চ অ্যাসিসন্টেটশশিপেরও সুযোগ আছে যা মাস্টার্সেও পেতে পারেন তবে পিএইচডি লেভেলে সর্বাধিক। পড়াশোনা করা অবস্থায় এখানে চাকরি করার অনুমতি মিলবে। আপনি ছুটির দিনে অনায়াসে কাজ করতে পারবেন, পুরো দিন চাকরি করলে আপনি পাবেন বছরে ১২০ দিনের অনুমতি, অর্ধেক দিনের ক্ষেত্রে ২৪০ দিন।

পার্টটাইম চাকরি করে নিজের খরচ নিজে বহন করে বিয়ের জন্যও কিছু জমিয়ে টাকা রাখা সম্ভব। এখন প্রশ্ন হলো চাকরি পাব তো? চাকরির পাওয়ার ক্ষেত্রেও বলতে হয় শহরের ভূমিকা বেশ উল্লেখযোগ্য অর্থাৎ বড় শহরে চাকরি যতটা সহজে পাওয়া যাবে ছোট শহরে ততটা নয়। পড়াশোনা বুঝে উঠে, নতুন জায়গায় অভ্যস্ত হওয়া, ভাষাগত ব্যাপার, সব মিলিয়ে অনেকে এক মাসেও পায় অনেকে ছয় মাসেও নয়। তবে সিনিয়ররা বলেন, প্রথম ছয় মাস চাকরি না করে পড়াশোনায় মন দেওয়াটাই উত্তম। তাই অন্তত প্রথম চার মাস নিজের পকেট থেকে খরচের মানসিকতা রাখাই ভালো। আমার উপদেশ থাকবে জার্মানি আসবেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে প্রাথমিক জার্মান ভাষা শিখে আসবেন। এটি আপনাকে সব জায়গায় অনেকখানি এগিয়ে রাখবে।

এই হলো জার্মানিতে আসার আদ্যোপান্ত। সবকিছু ঠিক থাকলে এবার নেমে পড়ুন কোমর বেঁধে। এই লেখা পড়ে কেউ উপকৃত হলে ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার নেই, জার্মানি আসার সময় এক প্যাকেট বিরিয়ানি আর কিছু ফুচকা-পেঁয়াজু নিয়ে আসলেই হবে; অনেক দিন খাইনি!
একটি কথা বলাবাহুল্য, পুরো পৃথিবীতে ভারতীয় ও চাইনিজরা ছড়িয়ে গেছে। এরাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেবে। বিলিভ ইট অর নট, এরা যে যোগ্যতায় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে, তা কিন্তু নয়! কম আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম বিমুখতা ও হোমসিকনেসের কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিটের জন্য ১০০ জন পরীক্ষা দিচ্ছি এবং একটি চাকরির জন্য ৫০০ জন্য আবেদন করছি। তাই নিজের যেটুকু যোগ্যতা আছে তা কাজে লাগিয়ে স্বপ্নের ঘুড়ি আকাশে ভাসিয়ে দিতে পারলেই বাংলাদেশিরা পারবে আগামী বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিতে।

সবশেষে, লাল সবুজের পতাকা উড়ুক পৃথিবীর সকল দেশে, বাঙালিদের পদধূলি ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বের আনাচে কানাচে, জয় হোক সকল স্বপ্নবিলাসী শিক্ষার্থীর! ওয়েলকাম টু ডয়েচল্যান্ড!
*Rabiul H Chowdhury, Masters in Chemistry, Department of Chemistry and Biology, University of Siegen, Siegen, Germany. For any inquiry: rabiul_nh_ctg@yahoo.com

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।

More News Of This Category