আবহমান কাল থেকে গতানুগতিক রীতি নীতিতে চলমান ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত কিংবা বংশ পরাম্পরায় চলে আসা ব্যবসাকেই আমরা মুলত ট্রেডিশনাল বা ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা হিসেবে বুঝে থাকি! বিংশ শতাব্দীতে এসে ব্যবসার ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন সময়ের সাথেই হয়েছে।
তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে প্রাপ্ত সুবিধার কারনেই মূলত এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। সেই সাথে হুমকীর মুখে পড়ে সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও বিলুপ্ত হয়েছে। আরও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যাদের প্রাণও ওষ্ঠাগত!
এতকিছুর পরেও সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত ট্রেডিশনাল ব্যবসা সবচেয়ে জনপ্রিয় ও স্থায়ী ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা। যদিও ট্রেডিশনাল ব্যবসা ছাপিয়ে ইলেকট্রনিক কমার্স ব্যবসার পরিধির ব্যাপকতা বিশ্ব জয় করেছে। তবুও তারা কোন না কোন ভাবে ট্রেডিশনাল ব্যবসায়ীদের সাথেই সংযুক্ত!
উবার পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ রাইড সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যাদের নিজেদের কোন ভাড়ার গাড়ি নেই। একটি মাত্র ধারণা নিয়ে তারা সারা বিশ্বের ভাড়ায় পরিবহন সেবায় এনেছে ব্যপক পরিবর্তন। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি যাদের গাড়ি ভাড়া নিয়ে ক্রেতাদের রাইড সেবা দিচ্ছে তাদের তাদের অনেকেই ট্রেডিশনাল রেন্ট এ কার ব্যবসার সাথে আছে!
আরও এমন উদাহরণের খাতাটা না হয় একটু পরেই খোলা যাক। ততক্ষণে বরং চোখ বুলিয়ে আসি দেশে কাজ না পেয়ে চপ্পলের তলা ক্ষয় করে যাওয়া কিংবা পরিবার পরিজনের মুখে একমুঠো ভাত গুজে দেওয়ার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়ে অথই সাগরে ভেসে বেড়ানো বেকার মানুষগুলোর কাছ থেকে!
১৮ কোটির দেশে সরকারী হিসেবে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ! যারা বেকার নয় তাদের কথায় আসি এবার- সপ্তাহে মাত্র এক ঘন্টা কাজ করেন এমন ব্যাক্তিও বেকার নন। পরিবারের কাজ করেন কিন্তু কোন মজুরী পান না তিনিও বেকার নন! কৃষক শ্রেনী যাদের বছরের ছয় মাস কোন ধরনের কাজের নিশ্চয়তা থাকে না তখনও তিনি বেকার নন। বিশ্বব্যাংক অবশ্য মনে করে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ হিসাবে দেশের ২ কোটি ২ লাখ লোক বেকার। তাতে কি যায় আসে!
বেকারত্বের ভয়াবহতা নতুন করে বলার কিছু নেই। যেখানে আমাদের আশি লাখের অধিক লোক বিদেশের শ্রম বাজার থেকে ১৫০০ কোটি ডলার আয় করে নিয়ে আসে ঠিক সে সময়েই দুই লাখ বিদেশী ৫০০ কোটি ডলার নিয়ে যায়! যোগ্যতা সম্পন্ন দক্ষ কর্মীর অজুহাতে দেশের শ্রমবাজারে বিদেশীদের ঠাঁই হয় কিন্তু দেশের জনগোষ্ঠীকে যোগ্যতা সম্পন্ন করে তোলার নেই পরিপূর্ণ উদ্যোগ!
এই যখন অবস্থা তখন একজন নিন্মবিত্ত চা দোকানী কিংবা রিকশাওয়ালাও মাসে ত্রিশ হাজার টাকা আয় করে তার পরিবারের জন্য। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে একজন বেকারকে আট হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরীর জন্য সিভি হাতে লাইন দিতে হয় দুয়ারে দুয়ারে! অবশ্য নিয়োগকর্তাদের আকর্ষণ কিন্তু চমৎকার! বেতন আলোচনা সাপেক্ষ!
লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকারের মধ্যেও কিছু সাহসী ছেলে-মেয়েদের দেখা মেলে। কিন্তু সেখানেও ভরসা করা খুব কঠিন হয়ে যায়। ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে তারা সফল হতে চায়। ট্রেডিশনাল যে কোন কিছুতে তাদের অনীহা! ইলেকট্রনিক্স কমার্সের আদ্যোপান্ত না বুঝে বিনিয়োগ করে। নেই কোন রিসার্স! নেই কোন ডেভেলপমেন্ট! নেই মার্কেট এ্যানালাইসিস! বিনিয়োগ করে ঠিকই টাকা আর ঘরে আসে না। এদের অবশ্য বিশাল স্বপ্ন।
সিইও ছাড়া তারা অন্যকিছুতে নিজেকে যোগ্য মনে করে না। এদের অনেকে আবার সিইও এর বাংলাটা কি সেটাও জানে না। ঘরের কথা পরকে বলতে নেই। এদের আইডিয়া এতটাই ইনোভেটিভ হয় তা না কি অন্যেরা জানলে চুরি করে নিয়ে সফল হয়ে যেতে পারে তাই শেয়ারও করে না কারও সাথে! সে যাই হোক প্রতিভাবান এ সকল ছেলে-মেয়ের আচরণ দেখলে হাসি আসে তবে কান বন্ধ রেখে শুনতে হয়! এতে অবশ্য ধৈর্য্য বাড়ে!
ট্রেডিশনাল ব্যবসার ভিত্তি স্থায়ী। ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়ে। পরিশ্রম করলে এখান থেকে সাম্রাজ্য গড়া যায়! কিন্তু সূর্যদয়ে যাদের ভয় তারা ঘাম ঝড়াতেই বড্ড বেশী কষ্ট পায়! লেগে থাকাতে নয় স্বপ্নে ভেসে বড় হতে গিয়ে পা পিছলে যেতেই ব্যস্ত। যে বীজের অঙ্কুরোদগমে একটা বিশাল বটবৃক্ষ হতে পারত তা গিয়ে কোন এক অফিসের ছোট্ট চিপায় সারা মাস পড়ে থেকে দিন গুনতে ব্যস্ত থাকে কবে মাস যাবে! কবে বেতনের টাকাটা হাতে পাবে!
সম্ভবনাগুলো ভয়ংকর এক রুপ নেয়। ভবিষ্যতেও নিজ উদ্যোগে কোন কিছুতে হাত দিবে সে সাহস হারায়। একে একে পুরোপুরি দাসত্ববৃত্তির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। তাকে ঘিরে দখলের রাজত্ব চলতে থাকে। থেমে যায় উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পটা। থেমে যায় সম্ভাবনার গল্পটাও।
আমাদের দেশে ট্রেডিশনাল সফল ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম নয়। তার বিপরীতে ইলেকট্রনিক্স কমার্স ব্যবসায় সফল কিন্তু মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। সারা বিশ্বের হিসাব করলে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি ইলেকট্রনিক্স কমার্স ব্যবসা সফলতা পেয়েছে। সেখানে পুরো ব্যবসায়িক ব্যবস্থা এখনও ট্রেডিশনাল। আর সেই ট্রেডিশনাল ব্যবসায়কে অবহেলা করে অলীক ব্যবসার পিছনে ছুটে সফলতা পাওয়ার চিন্তা নিত্যান্তই বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়!
লেখক: মোঃ মাসুদুর রহমান মাসুদ
উদ্যোক্তার খোঁজে ডটকম।