ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে মার্সিডিজ এসি বাস ছিল বাগদাদ গ্রুপের। ২০১৩-১৪ সালের দিকে ডজন খানেকের বেশি বাস নিয়ে এ রুটে চলাচল শুরু করে বাগদাদ এক্সপ্রেস। চার-পাঁচ বছরেই থেমে গেছে পরিবহন সেবা। প্রতিষ্ঠানটি হয়েছে খেলাপি। বর্তমানে বাগদাদ গ্রুপের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়েছে, যা খেলাপি হয়ে গেছে।
পাওনাদার ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাগদাদ গ্রুপের কাছে পাওনার মধ্যে রয়েছে— ইসলামী ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৪৬ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৩১ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার ১২ কোটি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১১ কোটি টাকা। এছাড়া আরো কয়েকটি ব্যাংকের টাকা আটকে আছে প্রতিষ্ঠানটির কাছে।
জানা যায়, বাগদাদ গ্রুপের কর্ণধার চট্টগ্রামের রাউজানের ফেরদৌস খান আলমগীর। তার বাবা আইয়ুব খান ছিলেন সারের ডিলার। চট্টগ্রামের মাঝির ঘাটে সারের ব্যবসা থেকে একপর্যায়ে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় আসেন আলমগীর ও তার সহোদর। পরে মত্স্য আহরণ, আবাসন, পরিবহনসহ আরো কয়েকটি ব্যবসায়ের জন্য মেসার্স আলমগীর ব্রাদার্স, বাগদাদ ট্রেডিং, ফেরদৌস এন্টারপ্রাইজ, বাগদাদ এক্সিম করপোরেশন, বাগদাদ পরিবহন, বাগদাদ প্রপার্টিজ নামে প্রতিষ্ঠান খোলেন তারা।
এরপর ব্যাংকগুলো থেকে একের পর এক ঋণসুবিধা নেন। প্রথমে ভালো লেনদেন করলেও পরে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে গড়িমসি শুরু করেন। একপর্যায়ে ব্যাংকগুলোর মোটা অংকের পাওনা আটকে যায়। ব্যাংক এশিয়ার কর্মকর্তারা জানান, ২০০৩ সালের দিকে ব্যাংক এশিয়া শেখ মুজিব রোড শাখার সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন বাগদাদ গ্রুপের কর্ণধার ফেরদৌস খান আলমগীর। তখন সরকারি আদেশে সার আমদানি করত মেসার্স আলমগীর ব্রাদার্স।
সার আমদানির জন্য ব্যাংক থেকে ঋণসুবিধা নিলেও ওই টাকা ব্যবহার হতো অন্যান্য খাতে। ওইসব ব্যবসায় লোকসান হলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির বন্ধক রাখা সম্পত্তিতেও মালিকানা নিয়ে ঝামেলা রয়েছে। এ অবস্থায় বাগদাদ গ্রুপের কাছ থেকে ব্যাংকের সাড়ে ১১ কোটি টাকা পাওনা আদায় খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
ব্যাংক এশিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব ব্রাঞ্চ (শেখ মুজিব রোড) আলী তারেক পারভেজ বলেন, মেসার্স আলমগীর ব্রাদার্স প্রথম সারির সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল। ব্যাংকের সঙ্গে ডিলিংও ভালো ছিল। ফলে সহজে ঋণ পেয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা অন্যান্য খাতে ব্যবসা শুরু করলে ব্যাংকের ঋণ আটকে যায়। ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করায় ২০১০ সালে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। কিন্তু আইনি জটিলতায় সে ঋণের টাকা এখনো উদ্ধার হয়নি।
জানা গেছে, রূপালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে এলটিআর, টার্ম লোনসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ঋণসুবিধা নিয়েছে মেসার্স বাগদাদ ট্রেডিং। কিন্তু ঋণ নেয়ার পর পরই কিস্তি পরিশোধে গড়িমসি করে প্রতিষ্ঠানটি। বহু চেষ্টার পরও ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়ায় ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে ব্যাংকটি।
ওই মামলায় তিন সহোদর ফেরদৌস খান আলমগীর, তানভীর খান আলমগীর ও আজাদ খান আলমগীরকে বিবাদী করা হয়। বর্তমানে বাগদাদ ট্রেডিংয়ের কাছে রূপালী ব্যাংকের মোট পাওনা ৪৫ কোটি ৬৮ লাখ ৭৪ হাজার ৮৫ টাকা। মামলার আট বছর পার হলেও এখনো টাকা আদায় সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা।
এদিকে খেলাপি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পরও ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণসুবিধা দেয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। পরিবহন খাতে ব্যবসার জন্য ব্যাংকটির প্রবর্তক শাখা থেকে এ ঋণ নেয়া হয়েছে। কিন্তু ঋণ নেয়ার পর ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য কোনো টাকা ফেরত দেয়নি
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। দীর্ঘ পাঁচ বছরেও ঋণের টাকা ফেরত না পেয়ে সম্প্রতি আইনি পদক্ষেপের উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা। গত অক্টোবরে চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা উল্লেখ করা হয়েছে ৩০ কোটি ৭৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
২০১০ সালে খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানকে ২০১৩ সালে ঋণ দেয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, পরিবহন ব্যবসার জন্য ঋণ নিয়েছে বাগদাদ পরিবহন। ঋণের টাকায় সড়কে গাড়ির ব্যবসা করেছে ঠিকই কিন্তু ব্যাংকের পাওনা শোধ করেনি। দীর্ঘ পাঁচ বছরেও ব্যাংকঋণ শোধ না করায় সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে ব্যাংক। বর্তমানে মামলাটি চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন।
বাগদাদ গ্রুপের দেনার মধ্যে আরো আছে— ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার প্রায় ৫০ কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১১ কোটি টাকাসহ আরো কয়েকটি ব্যাংকের বড় অংকের ঋণ। তবে এসব ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পত্তির পরিমাণ খুবই সামান্য। এ অবস্থায় ঋণ আদায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা। গ্রুপের তিন কর্ণধারের মধ্যে তানভীর সপরিবারে কানাডা রয়েছেন। আলমগীর ও আজাদের সন্ধান নেই পাওনাদার ব্যাংকগুলোর কাছে।
এদিকে গত কয়েক বছরে বাগদাদ গ্রুপের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বিলাসবহুল মার্সিডিজ বাসগুলো গ্যারেজে পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ বাস নগরীর সাগরিকা এমএ হান্নান স্টেডিয়ামের পাশে ও কয়েকটি বাস হালিশহরে চট্টগ্রাম আবাহনী মাঠের পশ্চিম পাশে একটি গ্যারেজে রাখা হয়েছে।
বাগদাদ এক্সপ্রেসের টিকিট কাউন্টারের বেশির ভাগই বন্ধ অথবা সেখানে অন্য কোনো বাসের টিকিট বিক্রি করছে। যেমন ঢাকার আরামবাগ এলাকায় বাগদাদ এক্সপ্রেসের কাউন্টারে এখন লন্ডন এক্সপ্রেস নামে বাসের টিকিট বিক্রি করতে দেখা গেছে। জানা গেছে, ফেরদৌস খান আলমগীর ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। তাছাড়া তিনি সাউদার্ন ইউনিভার্সিটিরও পরিচালক। তথ্যসূত্র: বণিক বার্তা।