রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাবের দোহাই দিয়ে একসময়ের বিমুখ উত্তরা, ঈশ্বরদী ও মোংলা ইপিজেডে আবার ফিরতে শুরু করেছে বিনিয়োগ। গত এক বছরেই ইপিজেড ভেদে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে রপ্তানি। বাস্তবায়নাধীন আছে আরো ১৯টি কারখানা। বিশেষ প্রণোদনা এবং ব্যাপক প্রচারণার কারণেই এই ইপিজেডগুলোতে সুদিন ফিরছে বলে বেপজা সূত্রে জানা গেছে।
পিছিয়ে থাকা এই তিন ইপিজেডকে এগিয়ে নিতে গৃহীত পদক্ষেপের সুফল পেতে শুরু করেছে বেপজা। এ ক্ষেত্রে বেশ ভালো ব্যবধানেই এগিয়ে গেছে নীলফামারী জেলায় অবস্থিত উত্তরা ইপিজেড। গত অর্থবছরে এই ইপিজেড থেকে সর্বমোট ১৮৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের ৮৭ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় প্রায় ২১৪ শতাংশ বেশি।
এ সময় কর্মসংস্থান বেড়েছে সাত হাজার ১২৪ জন। ঈশ্বরদী ইপিজেড থেকে গত অর্থবছরে ১১৪ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ছয় মিলিয়ন ডলার বেশি।
তবে এ ক্ষেত্রে মোংলা ইপিজেডের রপ্তানি ও কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে নেতিবাচক। গত অর্থবছরে এই ইপিজেড থেকে ৭৪ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১০ মিলিয়ন ডলার কম। তবে এই ইপিজেডে চালু থাকা ২২টি কারখানার সঙ্গে নতুন করে আরো ১১টি কারখানা বাস্তবায়নাধীন।
এই তিন ইপিজেডে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বেপজার পক্ষ থেকে অনেক প্রণোদনা কার্যকর রয়েছে। যেমন অন্যান্য ইপিজেডের তুলনায় উত্তরা, ঈশ্বরদী এবং মোংলা ইপিজেডের জমি ও ভবন ভাড়া প্রায় অর্ধেক। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কর্ণফুলী, আদমজী এবং কুমিল্লা ইপিজেডে যেখানে প্রতি বর্গমিটার জমির বার্ষিক ভাড়া ২ দশমিক ২ ডলার, সেখানে উত্তরা, ঈশ্বরদী এবং মোংলা ইপিজেডের জমির ভাড়া ১ দশমিক ২৫ ডলার। একইভাবে অন্য ইপিজেডগুলোতে বেপজা স্ট্যান্ডার্ড কারখানা ভবনের বর্গমিটারপ্রতি ভাড়া মাসে ২ দশমিক ৭৫ ডলার, অথচ এই তিন ইপিজেডে ভাড়া মাত্র ১ দশমিক ৬০ ডলার।
এ ছাড়া অন্য ইপিজেডগুলোতে যেখানে বিনিয়োগে বিভিন্ন মেয়াদে পাঁচ বছর কর অব্যাহতি দেওয়া হয়, সেখানে উত্তরা, ঈশ্বরদী এবং মোংলা ইপিজেডে বিনিয়োগে কর অব্যাহতি পাওয়া যায় সাত বছর। এর বাইরে বেপজার পক্ষ থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান ইপিজেডে বিনিয়োগকারীদের পিছিয়ে থাকা তিন ইপিজেডে বিনিয়োগের জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। এসব উদ্যোগের সুফল পেতে শুরু করেছে বেপজা।
বেপজা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বর্তমানে এই তিন ইপিজেডে ৫০টি কারখানা চালু আছে। এ ছাড়া আরো ১৯টি শিল্প-কারখানা বাস্তবায়নাধীন। বিগত তিন বছরে (২০১৪, ২০১৫, ২০১৬) ওই তিনটি ইপিজেডে বিনিয়োগের লক্ষ্যে ২০টি নতুন প্রতিষ্ঠান বেপজার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তিনটি ইপিজেডে মোট শিল্প প্লটের সংখ্যা ৬৮৪টি, যার মধ্যে ৭০ শতাংশ ইতিমধ্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বরাদ্দ করা হয়েছে।
বিনিয়োগ এবং রপ্তানি বাড়ার প্রসঙ্গে বেপজার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু বড় কারখানা উত্পাদন শুরু করেছে এই ইপিজেডগুলোতে। এ কারণে রপ্তানি এবং কর্মসংস্থানে বেশ ভালো প্রভাব পড়েছে। প্রণোদনার সুযোগ নিতে অন্য ইপিজেড থেকে অনেকে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে সেখানে। এই ইপিজেডগুলোতে বিনিয়োগের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে গার্মেন্টনির্ভর শিল্প কম, বৈচিত্র্যময় পণ্যের কারখানা বেশি।’
অন্য দুই ইপিজেডের তুলনায় মোংলা ইপিজেড কিছুটা পিছিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে নাজমা বিনতে আলমগীর আরো বলেন, ‘এই ইপিজেডটি খুব শিগগির বিনিয়োগকারীদের তীর্থভূমিতে পরিণত হবে। কারণ খুলনা অঞ্চলকে ঘিরে সরকারের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর বাস্তবায়ন এবং গ্যাস সংযোগ পেলে মংলা ইপিজেডে বিনিয়োগকারীরা ছুটে আসবে।’
তবে অন্য ইপিজেডের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও ‘ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড’-এর মতো বিশ্বসেরা গ্রিন কারখানা ঈশ্বরদী ইপিজেডে অবস্থিত। বিনিয়োগকারীদের ঈশ্বরদী ইপিজেডমুখী করার ক্ষেত্রে এটি অনেক বড় একটি বিজ্ঞাপন। বাংলাদেশের এবা গ্রুপের এ কারখানা ঈশ্বরদী রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায়।
ইউএসজিবিসির (ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল) কাছ থেকে প্লাটিনাম সনদ পাওয়া ৯ দশমিক ২ একর জমির ওপর গাছগাছালিঘেরা ভিনটেজ ডেনিম। ১৯টি প্লটে চার লাখ ৭১ হাজার বর্গফুটের মধ্যে দুই লাখ ৯৮ হাজার বর্গফুটজুড়ে নির্মিত স্টিল কাঠামোর ভবন। ৩০ শতাংশ জায়গা বিনোদন, খেলার মাঠ, চলাচলের করিডর ও অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থার জন্য ছেড়ে দেওয়া। সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে গড়ে তোলা কারখানাটিতে স্থায়ী বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলার বা ১৪০ কোটি টাকা।
ঈশ্বরদী ইপিজেডে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রিন প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য শুরু থেকেই আমরা এমন জায়গা চেয়েছি যেটা হবে নিষ্কন্টক। এ ছাড়া গ্রিন কারখানা নির্মাণের শর্ত হিসেবে স্থানীয় উৎস থেকে নির্মাণের ৩০ শতাংশ পেতে হবে। এসব বিবেচনায় আমরা ঈশ্বরদী ইপিজেডে ২০১০ সালে বিনিয়োগ করি।
২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে উত্পাদনে আসার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় মে মাসে ইউএসজিবিসির প্লাটিনাম সনদ পাই। এখানে কর্মরত দুই হাজার ৬৩০ জন কর্মীর ৮২ শতাংশই নারী, যারা আশপাশের গ্রাম থেকেই কাজ করতে আসে।’ ভিনটেজ ডেনিমকে দেখে ঈশ্বরদী ইপিজেডে অনেকেই গ্রিন কারখানা করতে আগ্রহী হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইপিক গ্রুপ এবং রেনেসাঁ গ্রুপ গ্রিন কারখানা স্থাপনে তাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে বলে জানান কামরুল ইসলাম। তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ।